ফেব্রুয়ারি মাসের ২৯ তারিখ। দুর্লভ একটি দিন। অধিবর্ষ বা লিপ ইয়ারে কেউ জন্মগ্রহণ করলে চার বছরে মাত্র একবারই দিনটি উদযাপন করা সম্ভব। ১৯৪৮ সালের এই দিনেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন বাংলাদেশের মঞ্চ, টিভি ও চলচ্চিত্র জগতের গুণী কিংবদন্তি নাট্যজন মামুনুর রশিদ। দেশের সংস্কৃতি অঙ্গনকে যারা সব সময় সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম নাট্যব্যক্তিত্ব তিনি।
দেশের নাট্য আন্দোলনের অন্যতম প্রাণপুরুষ আরণ্যক নাট্যদলের প্রতিষ্ঠাতা মামুনুর রশীদ জন্মগ্রহণ করেন টাঙ্গাইলের পাইকড়া গ্রামে মাতুলালয়ে। বাবা হারুনুর রশীদের ডাক বিভাগে সরকারি চাকরির সূত্রে ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশের বিভিন্ন জেলার স্কুল-কলেজে। ঢাকা পলিটেকনিক থেকে পুরকৌশল বিভাগে ডিপ্লোমা করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে করেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বিএ ও এমএ। ১৯৬৭ সাল থেকেই বাংলাদেশ টেলিভিশনে নাটক লিখতে শুরু করেন মামুনুর রশীদ। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন তিনি। জড়িয়ে পড়েন স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের সঙ্গে। তার উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে রয়েছে- ‘ওরা কদম আলী’, ‘ওরা আছে বলেই’, ‘ইবলিশ’, ‘এখানে নোঙর’, ‘রাঢ়াং’, ‘চে’র সাইকেল’ প্রভৃতি। শহীদুল্লা কায়সারের ‘সংশপ্তক’ উপন্যাসটির প্রথম নাট্যরূপও দিয়েছেন তিনি।
গত ২৯ ফেব্রুয়ারি গুণী এই শিল্পীর জন্মদিন উপলক্ষে শিল্পকলা একাডেমিতে তার রচিত পাঁচটি নাটক মঞ্চায়ন, সংগীত, নৃত্য, সেমিনার, প্রদর্শনী, গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন, সংবর্ধনা ও থিয়েটার আড্ডা নিয়ে ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত আয়োজন করা হয় ছয় দিনব্যাপী ‘দ্রোহ, দাহ স্বপ্নের’ নাট্য আয়োজন। উৎসব উপলক্ষে বিকেল থেকেই শিল্পকলা একাডেমির নন্দন মঞ্চে শুরু হয় মাদলের বাদ্য-বাজনা। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই শুরু হয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। একাডেমির নৃত্যশালা মিলনায়তনে মামুনুর রশীদের মঙ্গল কামনায় প্রদীপ প্রজ্বালন করা হয়। নন্দন মঞ্চে বর্ণিল আয়োজনে মাদলের বাজনার সঙ্গে মামুনুর রশীদের জন্মদিনের এ উৎসবের উদ্বোধন করেন অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ। নাট্যব্যক্তিত্ব হারুন-অর-রশিদের সঞ্চালনায় উদ্বোধনী আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন রাজনীতিবিদ রাশেদ খান মেনন, ভারতের কলকাতার সংস্কৃতিজন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় ও দেশের বরেণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা।
অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করে হায়াৎ মামুদ বলেন, নাটক যারা পছন্দ করেন, নাটক পাঠ করেন, নাটক শোনেন- নাটকই তাদের ডেকে আনে। রাশেদ খান মেনন বলেন, মামুনুর রশীদ এখনো সেই ১৮ বছরের উদ্যম নিয়ে মঞ্চ নাটক, ছোট ও বড় পর্দা সব জায়গায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, আপনারা ভাগ্যবান। আপনারা মামুনের অভিনয়, তার প্রযোজনা- এগুলো বার বার দেখার সুযোগ পান। অনুষ্ঠানে মামুনুর রশীদ বলেন, চার বছর পরপর জন্মদিন হওয়ায় আমার বয়স এখন ১৮ বছর। কবি সুকান্তের একটি অসাধারণ কবিতা আছে, যে ১৮ বছরের বয়স একটা গুরুতর সময়। এ সময় মানুষের দ্রোহ, দাহ এবং স্বপ্নের সময়। ১৮ বছর বয়সের যে দুর্দমনীয় সময় সেই সময়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমি চেষ্টা করব আবার জেগে উঠতে। চেষ্টা করব দ্রোহ, দাহ ও স্বপ্নের আয়োজন করতে।
মামুনুর রশীদের ১৮তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ২৯ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ১০টায় শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে অভিনয় শিল্পী সংঘের সম্মিলনী ও শুভেচ্ছা নিবেদনের আয়োজন করা হয়। বিকেল সাড়ে ৪টায় একই হলে অনুষ্ঠিত হয় ‘মামুনুর রশীদের নাট্যভাবনা এবং আমাদের নাট্যচর্চা’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে মুখ্য আলোচক হিসেবে ছিলেন কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল হলে ‘অভিনন্দন, জীবন ও শিল্পের মামুনুর রশীদ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, গোলাম কুদ্দুস এবং সুবর্ণা মুস্তাফা।