টিভি নাটকের মাধ্যমে অভিনয়ে অভিষেক আলীরাজের। ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’ নাটকে প্রথম অভিনয় করেন। সে সময় তিনি ডব্লিউ আনোয়ার নামে পরিচিত ছিলেন। ছেলেবেলায় সিরাজগঞ্জে থাকতেই বর্ণালী ক্লাবের হয়ে অভিনয় শুরু করেন। এরপর ঢাকা এসে ঢাকা থিয়েটারে কাজ শুরু করেন। চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় নায়করাজ রাজ্জাকের হাত ধরে। তার নির্দেশনায় ‘সৎ ভাই’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সিনেমাতে নিয়মিত হন। নায়করাজ রাজ্জাকের দেয়া নাম হলো আলীরাজ
আনন্দধারা : অভিনয়ের শুরুর গল্পটা জানতে চাই?
আলীরাজ : আমার শুরুটা ছিল থিয়েটার দিয়ে। আমি ঢাকা থিয়েটারে কাজ করতাম। এরপর বিটিভির মাধ্যমে টেলিভিশন নাটকে কাজ শুরু করলাম। তখন ছিল বিটিভির সাদাকালো যুগ। বিটিভিতে ধারাবাহিকভাবে অনেকগুলো কাজ করলাম। সে সময়ে ‘ঢাকায় থাকি’ নাটকে আমি আর তারানা অভিনয় করতাম। এই নাটকের মাধ্যমে রাজ্জাক ভাইয়ের পরিবারের কাছে আমি খুব প্রিয় হয়ে উঠি। এরপর রাজ্জাক ভাই শরৎচন্দ্রের বৈকুণ্ঠের উইল অবলম্বনে একটি সিনেমা বানাতে চাইলেন, নাম ‘সৎভাই’। এটার স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন গীতিকার রফিকুজ্জামান ভাই। ওনার মাধ্যমে রাজ্জাক ভাই আমাকে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন। আমি একটু ভেবে রাজি হয়ে গেলাম। সেখান থেকেই চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু। এখনো চলচ্চিত্রে নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছি।
আনন্দধারা : অভিনয়ের জীবনে মজার কোনো স্মৃতি রয়েছে কি?
আলীরাজ : আমার প্রচুর মজার স্মৃতি রয়েছে। পুরো জীবনটাই তো মজা করে পার করলাম। হুমায়ুন ফরীদি ভাই আমার পাঁচ বছরের সিনিয়র ছিলেন। তিনি কিন্তু অনেক বড় মাপের অভিনেতা ও গুণী মানুষ ছিলেন। তার সঙ্গেও কিছু স্মৃতি আমার খুব মনে পড়ে। আমরা একসঙ্গে আয়না ও ভাঙনের শব্দ শুনিতে অভিনয় করতাম। তখন আমরা রিকশায় গেলে সবাই বলত, হুমায়ুন ফরীদি আর ডব্লিউ আনোয়ার যায়। আমার আগে নাম ছিল ডব্লিউ আনোয়ার। এরপর সৎভাইয়ে রাজ্জাক ভাই আমার নাম দেন আলীরাজ। তখন থেকেই আমার নাম হয়ে যায় আলীরাজ। ফরীদি ভাইয়ের সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি ছিল। সেসব স্মৃতি আমাকে আজো ভাবায়, আমি আনন্দ পাই। আমার খুব মনে পড়ে তখন আমরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী ছিলাম না। কিন্তু বিটিভির ক্যান্টিনে বসে দুটো শিঙাড়া আর দুই কাপ চা খেয়ে খুবই তৃপ্তি পেতাম।
আনন্দধারা : আপনার অনুপ্রেরণা ছিল কারা?
আলীরাজ : আমি মফস্বলের ছেলে। ক্লাস ফোর থেকে মঞ্চে অভিনয় করতাম। আর মনের মধ্যে স্বপ্ন পুষে রাখতাম- যদি ঢাকায় যেতে পারতাম, টিভিতে অভিনয় করতে পারতাম। একসময় মফস্বলের ছোট্ট গ্রাম থেকে ঢাকায় এলাম। তখন বিটিভির ক্যামেরাম্যান ছিল আনোয়ার হোসেন বুলু। ও আমাকে ঢাকায় প্রচুর সাহায্য করেছিল। বুলু আমার বন্ধু ছিল। মূলত ওর মাধ্যমেই আমার ঢাকা আসা। ও আমার থাকার ব্যবস্থা করেছিল, আমাকে বিটিভিতে ইন্টারভিউ দেয়ার ব্যবস্থা করেছিল। আমি যে ডব্লিউ আনোয়ার হতে পেরেছিলাম তার পেছনে ওর অবদান সবচেয়ে বেশি।
আনন্দধারা : পারিবারিক কোনো বাধা ছিল কিনা?
আলীরাজ : আমার পরিবার অনেক হেল্পফুল ছিল। আমাকে অনেক উৎসাহ দিত। আমি আমার পরিবারের কাছে কৃতজ্ঞ। তাদের উৎসাহ না পেলে হয়তো আমি আলীরাজ হয়ে উঠতে পারতাম না।
আনন্দধারা : আপনার ক্যারিয়ারের টার্নিং ছবি ছিল কোনটি?
আলীরাজ : আসলে আমি মনে করি আমার প্রতিটি ছবিই আমার জন্য টার্নিং পয়েন্ট ছিল। এটা মনে রাখতে হবে মানুষ কিন্তু ইচ্ছা করে খারাপ ছবি বানায় না। সবারই ধারণা থাকে তার ছবি ব্যবসাসফল হবে, দর্শকপ্রিয় হবে। কিন্তু কিছু ছবি হয় না, সেটা কিন্তু আলাদা ব্যাপার। আমরা একটি ছবি বানানোর পর খারাপ ছবি বিচার করি। কিন্তু ওটাও তো ভালো ছবি হতে পারত, যদি ব্যবসাসফল হতো।
আনন্দধারা : অবসর কীভাবে কাটান?
আলীরাজ : আমার কোনো অবসর নেই। আমি এখনো নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছি। ইন্ডাস্ট্রিতে একটি ছবি এলেও আমাকে কিন্তু ডাকা হয়। ভালো লাগলে করি, না লাগলে করি না।
আনন্দধারা : আমি বলতে চাইছি, কাজের ফাঁকে অবসরে কী করেন?
আলীরাজ : কাজের ফাঁকে যেটুকু সময় পাই বাসাতেই থাকি। পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাই। আমার ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী, ছেলের বৌ- এদের নিয়ে পরিবার। কাজের ফাঁকের অবসরে তাদের সঙ্গে গল্প করি, আড্ডা দিই।
আনন্দধারা : আপনার প্রিয় লেখক কারা?
আলীরাজ : আমার প্রিয় লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। আমি একসময় তার বই প্রচুর পড়েছি। কিন্তু এখন আর সময়ের অভাবে বই পড়া হয়ে ওঠে না। তবে এক সময় বইয়ের পোকা ছিলাম।
আনন্দধারা : আপনার প্রিয় অভিনেতা কারা?
আলীরাজ : এখনকার অভিনেতাদের মধ্যে নাটকের কয়েকজনের অভিনয় ভালো লাগে। তারা হলেন- জাহিদ হাসান, চঞ্চল চৌধুরী, মোশাররফ করিম। আর প্রিয় অভিনেতারা হলেন- আফজাল হোসেন, আসাদ, মামুন, আবুল খায়ের ভাই, নূর ভাই, ফেরদৌসী ভাবী। তারা সবাই অসম্ভব ভালো অভিনয় করতেন। আমি সবসময় তাদের অভিনয় দেখে অনুপ্রাণিত হতাম। আমি আনোয়ার হোসেনের সঙ্গেও অভিনয় করেছিলাম। আমি মনে করি এটা আমার জন্য ছিল খুবই সৌভাগ্যের ব্যাপার।
আনন্দধারা : কোন ধরনের চরিত্রে আপনি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন?
আলীরাজ : এটা আমার ওপর নির্ভর করে না। পরিচালক আমাকে সব ধরনের চরিত্রে অভিনয় করান। আমাকে ভিলেন বানাচ্ছে, আমাকে দিয়ে কমেডি ক্যারেক্টারও করাচ্ছে, আমাকে দিয়ে রোমান্টিক করায় আবার আমাকে দিয়ে দুঃখের চরিত্রও করায়। পরিচালকরা যেটা দেয় আমি সেই চরিত্রেই স্বচ্ছন্দ বোধ করি।
আনন্দধারা : চলচ্চিত্রের এই দীর্ঘ ক্যারিয়ারে আপনার কোনো অপ্রাপ্তি বা অভিমান আছে কি?
আলীরাজ : না, অভিমান থাকবে কেন! অভিমান তখন হবে যখন কোনো কিছু জানব না, যে যার মতো যা খুশি করে ফেলবে। আমি তো সবকিছু দেখছি। আমি এই জগৎ থেকে অনেক পেয়েছি। অভিনেতা হতে পেরেছি।