২০১৯ সাল সংগীতের জন্য হতাশার বছর, সংগীতাঙ্গন ক্রমাগতভাবে খারাপের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কমে আসছে গান প্রকাশের সংখ্যা। দুই ঈদ এবং বিভিন্ন উৎসবে গান প্রকাশের সংখ্যা একেবারে কমে এসেছে। বর্তমানে শিল্পীদের অনেকেই নিজ উদ্যোগে ইউটিউবে তাদের গান প্রকাশ করেছেন। অডিও কোম্পানিগুলো গানের চেয়ে এখন নাটক প্রযোজনায় বেশি ঝুঁকেছেন। আর যে গানগুলো তারা প্রকাশ হয়েছে বেশিরভাগই সৌখিন শিল্পীদের। তারকা শিল্পীদের গান তেমন একটা প্রকাশিত হয়নি।
প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গানের ওয়েলকাম টিউন থেকে তাদের আয় কমে শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত গানের ভিউ কমছে। বিষয়টিও বিরূপ প্রভাব ফেলেছে সংগীতাঙ্গনে। শিল্পীদের ব্যয়বহুল মিউজিক ভিডিও ইউটিউবে দেখছেন না দর্শকরা। তাই নতুন গানে বিনিয়োগ করছেন না প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো।
এমআইবি সভাপতি এ কে এম আরিফুর রহমান বলেন, চলতি বছরটি গানের জন্য মোটেই ভালো যায়নি। গানে যা বিনিয়োগ করে সেটা উঠিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। বছরের শুরু থেকে খারাপ অবস্থার সূত্রপাত হয়, যেটা এখনো কাটেনি। এমআইবির পক্ষ থেকে চেষ্টা করেছি এ অবস্থা থেকে উত্তরণের। ওয়েলকাম টিউন থেকে আয় কমেছে। ইউটিউবে গানের ভিউও তেমন হয়নি। তাই নতুন গানে বিনিয়োগ করা সম্ভব হয়নি। নতুন গান তেমন প্রকাশ করেছে কোম্পানিগুলো। আমরা চেষ্টা করছি এখনো এ অবস্থা থেকে বের হওয়ার। আশা করি নতুন বছরে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে ইন্ডাস্ট্রি।
সংগীতশিল্পী ফাহমিদা নবী বলেন, চলতি বছর গানের একটা অস্থির অবস্থা চলছে। নতুন গানও প্রকাশ কমেছে। এই সমস্যাগুলোর সুষ্ঠু সমাধান প্রয়োজন। সংগীতের সবাই একসঙ্গে এর সমাধান করতে পারে। তবে সমস্যা আর থাকবে না। একাত্মতার অভাব এক্ষেত্রে অনুভব করছি। সবাই এক হয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ যেন নেয়া হয়।
সংগীতশিল্পী ইমরান বলেন, চলতি বছর কিছুটা অস্থির ছিল আমাদের সংগীতাঙ্গন। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এমন ওঠানামা থাকবেই। এর মধ্যে থেকেই ভালো কাজ করার চেষ্টা করে যেতে হবে। আগামীতে সবার মিলিত চেষ্টায় মিউজিক অঙ্গনের গতি ফিরবে- সেটাই আশা করি।
সংগীতে উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে রয়েছে কিংবদন্তি শিল্পী রুনা লায়লার সুরে আশা ভোঁসলে, হরিহরণ, রাহাত ফতেহ আলি খান, আদনান সামির জন্য গান নিয়ে ‘রুনা লায়লা ফিচারিং লিজেন্ডস ফরএভার’ অ্যালবামটি।
জনপ্রিয় ব্যান্ড মাইলস ৪০ বছরপূর্তি উপলক্ষে ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় ২৮টি কনসার্টে অংশ নেয় মাইলস। যার শেষ কনসার্টটি ২৪ ডিসেম্বর ঢাকার বসুন্ধরা ইন্টারন্যাশনাল কনভোকেশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই আয়োজনে মাইলস ছাড়াও অন্য ব্যান্ডও অংশ নেবে।
কলকাতার জি বাংলার গানবিষয়ক রিয়েলিটি শো ‘সা রে গা মা পা’র মাধ্যমে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন বাংলাদেশের মাঈনুল আহসান নোবেল। সেখানে দ্বিতীয় রানারআপ হয়েছেন তিনি। সংগীতে তুমুল আলোচনায় ছিলেন এই কণ্ঠশিল্পী। জেমস ও আইয়ুব বাচ্চুর গানগুলো গেয়ে তুমুল শ্রোতাপ্রিয়তা লাভ করেন এই কণ্ঠশিল্পী। তবে বছর শেষে তাকে তেমনভাবে পাওয়া যায়নি।
সবচেয়ে বেশি গান প্রকাশের দিকে এগিয়ে ছিলেন আসিফ আকবর। এছাড়া ‘গহিনের গান’ নামের একটি সিনেমায় প্রথম অভিনয় করেন নায়ক হিসেবে। ছবিতে তার বিপরীতে ছিলেন তমা মির্জা ও তানজিকা আমিন। ছবিটি ২০ ডিসেম্বর মুক্তি পায়।
অচেনা গায়ক সুকুমার বাউলের গাওয়া ‘বলবোনা গো’ গানটি ২০১৯ সালে হঠাৎ করে ছড়িয়ে পড়ে শ্রোতাদের মধ্যে। সবখানে বাজতে শোনা যায় এই গানটি। কণ্ঠশিল্পী ইমরানের গাওয়া ‘আমার কাছে তুমি অন্যরকম’ গানটির মিউজিক ভিডিও শ্রোতারা পছন্দ করে। এই তালিকায় আরো রয়েছে কাজী শুভর গাওয়া ‘ভুলিয়া না যাইও’, শামস ভাইয়ের গাওয়া ‘ঘুম ভালোবাসি’ ও লায়লার গাওয়া ‘সখী গো আমার মন ভালো না’ গানগুলোর মিউজিক ভিডিও ইউটিউবে সাড়া ফেলে।
তবে ২০১৯ সালে সৈয়দ আবদুল হাদী, কুমার বিশ্বজিৎ, ফাহমিদা নবী, হাবিব ওয়াহিদ, কনা, মিনার, ন্যান্সি, ঐশী, লিজা, ঝিলিক, পূজা প্রভৃতি শিল্পী গানে নিয়মিত ছিলেন।
২০১৯ সালের ৭ মে ৬৬ বছর বয়সে মারা যান সুবীর নন্দী। গানের স্বীকৃতি হিসেবে পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। তার কণ্ঠে শ্রোতাপ্রিয় গানগুলো হলো- ‘দিন যায় কথা থাকে’, ‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়’, ‘পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই’, ‘আশা ছিল মনে মনে’, ‘হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে’, ‘বন্ধু তোর বরাত নিয়া’, ‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার’, ‘কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো’, ‘পাহাড়ের কান্না দেখে’, ‘আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি’, ‘একটা ছিল সোনার কইন্যা’, ‘ও আমার উড়াল পঙ্খীরে’।
বরেণ্য সংগীতশিল্পী শাহনাজ রহমতউল্লাহ ২০১৯ সালের ২৩ মার্চ মৃত্যুবরণ করেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। ১৯৯২ সালে একুশে পদক দেয়া হয় তাকে। ১৯৯০ সালে ‘ছুটির ফাঁদে’ ছবিতে গান গেয়ে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন। শিল্পীর গাওয়া শ্রোতাপ্রিয় গানগুলো হলো- ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’, ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’, ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে’, ‘আমার দেশের মাটির গন্ধে’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বল রে আমায় বল’, ‘আমায় যদি প্রশ্ন করে’, ‘যদি চোখের দৃষ্টি’, ‘সাগরের তীর থেকে’, ‘খোলা জানালা’, ‘পারি না ভুলে যেতে’, ‘ফুলের কানে ভ্রমর এসে’, ‘আমি তো আমার গল্প বলেছি’, ‘আরও কিছু দাও না’।
তরুণ শিল্পী, সুরকার ও সংগীত পরিচালক পৃথ্বী রাজ মারা গেছেন ২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর। সংগীতের পাশাপাশি এবিসি রেডিওতেও কাজ করতেন তিনি।