তার শেকড়টি এই মাটিতে হলেও আন্তর্জাতিক আকাশে ডালপালা মেলেছেন ভালোভাবেই। তিনি সরকার প্রতীক, একজন শিল্পী। তার কাজের মাধ্যম ফটোগ্রাফি। বড়মাপের অনেক আন্তর্জাতিক পুরস্কার এরই মধ্যে পাওয়া হয়ে গেছে বয়সে নবীন এই শিল্পীর। ২০১৪ সালে ব্রিটিশ জার্নাল অব ফটোগ্রাফি তাকে ‘ওয়ানস টু ওয়াচ’-এ ফিচার করে। ২০১৪-তে অংশগ্রহণ করেন ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো জুপ সোয়ার্ট মাস্টারক্লাসে। পরের বছর পিডিএনের ‘৩০ ইমার্জিং ফটোগ্রাফার’-এ নাম আসে তার। একই বছর ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো পুরস্কার পান তার দাদা-দাদীকে নিয়ে করা কাজটির (What Remains) জন্য। এখানেই তিনি থেমে থাকেননি। কাজ করে চলেছেন, আরো পুরস্কার পেয়েছেন। দেশে-বিদেশে অনেক প্রদর্শনী হয়েছে তার। বই প্রকাশিত হয়েছে। শরতের সন্ধ্যায় রেললাইনের পাশে বসে চা খেতে খেতে কথা হয় প্রতীকের সঙ্গে। জানতে চাই কীভাবে তিনি আজকের প্রতীক হয়ে উঠলেন। বুঝতে চাই কেন তিনি এমন ছবি তোলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকার সময় একটি ফোন কিনেছিলেন। ফোনে ক্যামেরা ছিল। তখনকার ফোনের ক্যামেরা এত আধুনিক ছিল না। এক বা দুই মেগাপিক্সেলের ক্যামেরা। ওই দিয়েই ছবি তোলা শুরু। বন্ধুর ছবি তুলেছিলেন বেশকিছু। বাসের জানালা দিয়ে বন্ধু তাকিয়ে ছিলেন। বন্ধুকে দেয়ার জন্য ছবিগুলো প্রিন্ট করতে গেলেন স্টুডিওতে। স্টুডিওর স্বত্বাধিকারী ও ফটোগ্রাফার আক্কাস মাহমুদকে প্রতীক আংকেল ডাকেন। তার কাছে প্রতীক জানতে পারলেন পাঠশালা নামে একটি স্কুলের কথা। এরপর পাঠশালায় পাঠ নেয়া শুরু। তখনো ফটোগ্রাফি নিয়ে ততটা সিরিয়াস নন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ বর্ষের পড়াশোনা চলছে। একই সঙ্গে পাঠশালায় সান্ধ্যকালীন ব্যাচে ক্লাস করছেন। স্কয়ারে চাকরিও শুরু করলেন। এটা ছিল নিজের সঙ্গে বোঝাপড়ার সময়। এরপর চাকরি ছেড়ে পুরোদস্তুর ফটোগ্রাফার হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
তারপর কীভাবে এতদূর এলেন প্রতীক? মা তাকে অনেক সমর্থন দিয়েছেন। বন্ধুরা পাশে ছিলেন। মাঝে একটা সময়ে যখন তিনি পাঠশালা ছেড়ে দিচ্ছিলেন প্রায়, তখন তার বন্ধু আহমেদ শাওকি তাকে ফটোগ্রাফি চালিয়ে যাওয়ার উৎসাহ দিয়েছেন। শিক্ষকদের অবদানকেও অনেক বড় করে দেখেন প্রতীক। শিক্ষকরা খোলা মন নিয়ে তাকে গ্রহণ করেছেন এবং দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
আরো শুরু থেকে বললে শিল্পচর্চার শুরুটা মিউজিকের মাধ্যমে। মা গান করতেন, আর বাবা অনেক গান শুনতেন। গান শুনতে শুনতে বড় হওয়াটা আজকের প্রতীককে তৈরি করতে সহায়তা করেছে বলে তিনি মনে করেন। মিউজিশিয়ান হতে চেয়েছিলেন। পরে পেশা হিসেবে মিউজিক পছন্দ হয়নি। তবে এখনো তিনি অনুশীলন করেন। প্রিয় মিউজিশিয়ানদের দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন। তারা যেভাবে নিজেদের জীবন থেকে তাদের কাজগুলো বের করে আনেন এবং যেভাবে শ্রোতাদের সঙ্গে মিউজিকের মাধ্যমে সংযোগ করেন, সেটিকে প্রতীকের মনে হয় শিল্পের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। মিউজিক যেভাবে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে, ভিজ্যুয়াল মাধ্যমে সেটি কঠিন। প্রতীক চান না, তার কাজ শুধু শিল্পীদের মধ্যে বা অভিজাত মহলে সীমাবদ্ধ থাকুক। একজন সাধারণ মানুষ যদি তার কাজ দেখতে পারেন এবং নিজের জীবনের সঙ্গে কাজটির সম্পর্ক খুঁজে পান, তাহলে তার ভালো লাগে। একজন মানুষ যখন তার প্রিয় গান শোনে, ওই গানের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত আনন্দ-বেদনার মুহূর্তগুলো এক হয়ে যায়। গানটি তার সঙ্গে থাকে, মনে থাকে। এটিই প্রতীকের মতে শিল্পের সবচেয়ে বড় ক্ষমতা।
মা-বাবার একমাত্র সন্তান প্রতীক। তার দাদা এবং নানা দু’জনেই চার্চের পুরোহিত ছিলেন। গ্রামের নিম্নবিত্ত জীবন থেকে তার বাবা-মা চলে আসেন শহরের জীবনসংগ্রামে। তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন প্রতীককে শিক্ষা-দীক্ষা দেয়ার, একটা সুন্দর জীবন দেয়ার। আঠারো বছর বয়সে তিনি বাবাকে হারান। প্রতীকের মনে হয় প্রতিকূলতার মধ্যেও তার ছেলেবেলা সুন্দর ছিল। এরপর বেড়ে উঠতে উঠতে অনেক পরিবর্তন দেখেছেন চারপাশে।
প্রতীকের ছবিগুলো দেখলে মনে হয় সময় থমকে গেছে। নিজেকে শুধু ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফার বলতে চান না প্রতীক। তিনি মনে করেন তার অনেক কাজ সরাসরি ডকুমেন্টারি নয়। কাজগুলো যেমন একদিকে তার ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত, একই সঙ্গে তা সামগ্রিকভাবে মানুষের জীবনের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দাদা-দাদীকে নিয়ে কাজটি তার জন্য খুবই ব্যক্তিগত। কাজটিতে বার্ধক্য, মৃত্যু, অবক্ষয়, হারিয়ে ফেলার অনুভূতি আছে। একজন দর্শক যখন কাজটি দেখেন, তিনিও ওই অনুভূতিগুলোর সঙ্গে নিজেকে সম্পর্কিত করেন। পদ্মা নদীতে প্রতীক যখন বছরের পর বছর ছবি তুলে যান, তখনো সেখানে ঘুরে ঘুরে আসে সেই ক্ষয়, ভূমিক্ষয়, হারিয়ে যাওয়া। গত তিন বছর ধরে তিনি দেশভাগ নিয়ে কাজ করছেন। এখানেও ক্ষয়, ধ্বংসাবশেষ চলে আসে। চলে আসে মানুষ ও প্রকৃতির ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। প্রতীকের আগ্রহের বিষয় আসলে সময়। সময়ের সঙ্গে যে জিনিসগুলো, সম্পর্কগুলো হারিয়ে যায়, বারবার সেখানে ফিরে যান তিনি।
একজন শিল্পী যে সময়ে ও বাস্তবতায় বাস করেন, তা তার কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত। সমসাময়িক একজন শিল্পী হিসেবে প্রতীক এক জটিল বাস্তবতায় বাস করেন। তিনি যেমন বাংলাদেশি, বাঙালি, একই সঙ্গে কাজের সূত্রে তিনি আন্তর্জাতিক। বিশ^ায়নের যুগে এখন আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি- কোনোকিছুই আগের মতো নেই। প্রতীকও তাই আর শুধু একটি ভৌগোলিক সীমারেখায় আবদ্ধ থাকতে পারেন না। চাইলেও তা সম্ভব হতো না। আরোপিত বাঙালি পরিচয়ে তাই তিনি নিজেকে দেখেন না। চেনা পৃথিবী দ্রুত বদলে যায়। মানুষ আজ মঙ্গলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ঘটছে তরতর করে। আবার একই সময়ে রাজনৈতিক মতভেদের কারণে একটি ছাত্রকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে, একজন মা মারা যাচ্ছেন গণপিটুনিতে। এই বাস্তবতা প্রতীকের কাছে অবাস্তব লাগে। এই সংকটের মাঝেই তার বসবাস।
প্রতীকের মতে, প্রাপ্তি দুই রকম। একটি হচ্ছে পুরস্কার, স্বীকৃতি- এসব। আরেকটি হচ্ছে কাজ করে যেতে পারা, অর্থাৎ গল্প বলা, গল্প নিয়ে ভাবা। এটিই প্রতীকের দৃষ্টিতে বড় প্রাপ্তি। তিনি কাজ করে যেতে চান। পুরস্কারের প্রয়োজন আছে। কিন্তু একজন শিল্পীর লম্বা সময়ের প্রাপ্তি বলতে তিনি বোঝেন অর্থপূর্ণ কাজ করাকে। প্রতীক ভাবতে চান, তার ১০ বছরের ফটোগ্রাফি জীবনে তিনি এমন ছবি তুলতে পেরেছেন কিনা, যা এখনো তিনি নিজে দেখতে চান বা মানুষকে দেখাতে ভালোবাসেন।
ভবিষ্যতে নিজেকে কোথায় দেখতে চান- এ প্রশ্নের জবাবে প্রতীক বলেন, আমাদের দেশের অনিশ্চিত বাস্তবতায় তিনি আসলে অনেক দূরের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করতে পারেন না। তার শিক্ষক শহিদুল আলমের কথা স্মরণ করেন প্রতীক। আজ পেছনে তাকালে প্রতীকের মনে হয় যে শহিদুল আসলে ভালো ফটোগ্রাফার তৈরি করার চেয়ে ভালো মানুষ তৈরি করাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। পাঠশালার নবীন শিক্ষার্থীদের দিকে তাকালে তিনি একসময়ের নিজেকে দেখতে পান। এ সময়টিতে ভালো কোনো কাজ তৈরি করতে না পারলে কর্মজীবনে প্রবেশ করার পর তা আরো অনেক কঠিন হয়ে যায়। তাদের চলার পথটি খুঁজে নিতে যদি কিছু অবদান রাখতে পারেন, তবে সেটিকেই প্রতীক নিজের সার্থকতা মনে করবেন।
একদিক থেকে দেখলে শিক্ষকতা এখন প্রতীকের জীবনের একটা বড় অংশ। পাঠশালায় শিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন। তবে শিক্ষক হওয়ার পরিকল্পনা তার ছিল না। নিজের শিক্ষকতাকে তিনি খুব একাডেমিক জায়গা থেকে দেখেন না। প্রতীক মনে করেন, তিনি মূলত একজন শিল্পী। পাঠশালায় তিনি নতুন উদীয়মান আলোকচিত্র শিল্পীদের কাজে সাহায্য করতে পারেন।
নতুনদের জন্য প্রতীক বলেন, যে সমর্থনগুলো আমরা পাই- চেয়ে বা না চেয়ে, সেগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। আর নিজের সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিয়ে তার মাঝেই কাজ করে যাওয়া প্রয়োজন। একটি পেশা হিসেবে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার অভাব, শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে দেশের অবকাঠামোগত দুর্বলতা- এসব প্রতিকূলতা ছিল, থাকবেই। এর মধ্য দিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। যা আছে, তা দিয়েই কাজ করতে হবে। আর যা করতে আপনি ভালোবাসেন, সেটাই করা উচিত। সামাজিকভাবেও আমাদের সেই কাজের ক্ষেত্রটি তৈরি করতে হবে। কারণ ওই কাজটি আপনি মন দিয়ে করবেন, প্রেম দিয়ে করবেন। এতে আরো ১০টা মানুষের ক্ষতি হবে না, বরং উপকার হতে পারে।
স্বপ্নের কথা জিজ্ঞেস করলে প্রতীক স্মিত হাসেন। মানুষের স্বপ্ন সময়ের সঙ্গে পাল্টায়। ব্যর্থতার মাঝে অনেক স্বপ্ন হারিয়ে যায়। মানুষের কোনো ক্ষতি না করে, প্রিয়জনদের নিয়ে একটা শান্তিপূর্ণ, সুস্থ জীবন যাপন করে যেতে চান প্রতীক। এটুকুই স্বপ্ন।
লেখক : শাহরিয়ার কবির হিমেল